When turned on automatically changes
the theme color on reload.
When turned on automatically changes
the theme color every 5 sec.
গ্যাসলাইটিং শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা প্রেমের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পরিবারের মধ্যে এবং কর্মস্থলেও একটি গোপন মানসিক নির্যাতনের রূপ নিতে পারে। পরিবারের সদস্যরা বা অফিসের সহকর্মীরা যখন গ্যাসলাইটিং কৌশল প্রয়োগ করে, তখন এটি শিকারকে আরও একাকী, বিভ্রান্ত, এবং নিজস্ব ক্ষমতা সম্পর্কে অস্থির করে তোলে।
পরিবারে বা কর্মস্থলে গ্যাসলাইটিংয়ের প্রভাব প্রায়ই অনুধাবন করা কঠিন, কারণ এটি ধীরে ধীরে ঘটে এবং এর পিছনে থাকে শক্তির একটা খেলা, যেখানে একজন ব্যক্তি অপরজনকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আজকের পর্বে আমরা জানবো কীভাবে পরিবারে এবং কর্মস্থলে গ্যাসলাইটিং কাজ করে এবং কীভাবে এটি ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আমাদের জীবনের প্রথম শিক্ষক আমাদের পরিবার। বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধ এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। কিন্তু কখনও কখনও, পরিবারেই গ্যাসলাইটিংয়ের কৌশল ব্যবহৃত হয়, যা শিকারকে তার আত্মবিশ্বাস হারাতে এবং নিজেকে অপরাধী মনে করতে বাধ্য করে।
গ্যাসলাইটিংয়ের মাধ্যমে বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যরা প্রভাব বিস্তার করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তাদের সিদ্ধান্তগুলোকেই একমাত্র সঠিক প্রমাণ করতে চায়। এটি শিশুর মানসিকতা, আত্মবিশ্বাস, এবং স্বীকৃতির ব্যাপারে গভীর প্রভাব ফেলে।
১. “তুমি ভুল বুঝছো” – ছোট কথায় আত্মবিশ্বাস ধ্বংস এটি পরিবারের মধ্যে খুব সাধারণ একটি কৌশল। কখনও কখনও, বাবা-মা তাদের সন্তানের অনুভূতিগুলো অস্বীকার করে এবং তাদের এই অনুভূতিগুলোকে "ভুল" বা "অতিরঞ্জিত" বলে উল্লেখ করেন। এতে সন্তানের মনে হতে পারে, "আমি ঠিক কী অনুভব করছি?" এবং একসময় সে তার অনুভূতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে যায়।
উদাহরণ: যদি কোনো সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে অবহেলা বা অপমানিত হয়, এবং সে যদি বলার চেষ্টা করে, "আমি কষ্ট পেয়েছি," তবে বাবা-মা তাকে বলবেন, “তুমি তো কিচ্ছু বুঝো না, তোমার বোধশক্তি সঠিক নয়।” এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস হতে শুরু করে।
২. আবেগের অস্বীকৃতি
অনেক সময় পরিবারে গ্যাসলাইটিংয়ের মাধ্যমে কাউকে তার আবেগ অস্বীকার করে দেয়া হয়। এটি মানসিকভাবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, এবং শিকার মনে করে যে সে সত্যিই তার অনুভূতি ভুল বোঝে।
উদাহরণ: মা যদি তার সন্তানকে বলে, “তুমি কখনোই কিছু বুঝতে পারো না, তুমি বাড়াবাড়ি করছো” বা “তোমার অনুভূতিগুলি অতিরঞ্জিত, তুমি কিছুতেই সঠিক নও।” একসময়, সন্তান তার আবেগকে অবজ্ঞা করতে শেখে এবং অনুভূতির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
৩. অতীতকে বিকৃত করা
গ্যাসলাইটাররা সাধারণত অতীতের ঘটনাগুলিকে বিকৃত করে। তারা তার পরিবার বা সন্তানদের স্মৃতিতে হস্তক্ষেপ করে, এবং বলে, "তুমি ঠিকমতো মনে করছ না, আমি তো কখনো এমন কিছু করি নি।"
উদাহরণ: যদি একটি সন্তান তার বাবা-মাকে কিছু স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন, “তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসতেন না,” তখন বাবা-মা তাকে বলবেন, “এটা তোমার ভুল মনে হচ্ছে, আমি কখনো এমন কিছু বলিনি।” এতে সন্তান বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং তাকে তার নিজের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য করে।
কর্মস্থলে গ্যাসলাইটিংয়ের কৌশলও একাধিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। কর্মস্থলে সাধারণত ক্ষমতার সম্পর্ক খুব জোরালো থাকে, এবং এখানে গ্যাসলাইটিং খুব সহজেই একজনকে মানসিকভাবে শিকার বানাতে পারে। বস, সহকর্মী, বা সাবঅর্ডিনেটরা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলার জন্য এই কৌশলটি ব্যবহার করতে পারে।
১. কাজের প্রতি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা
গ্যাসলাইটাররা কর্মস্থলে একজন কর্মীকে তার কাজের বিষয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলতে চায়। তারা বলে, "তুমি ঠিক জানো না কী করতে হবে," অথবা "তুমি যা করছো, তা কিছুই নয়।" এতে কর্মী তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে, এবং নিজের আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে।
উদাহরণ: এক সহকর্মী যদি আপনার কাজ নিয়ে বারবার বলে, “তুমি তো এটা সঠিকভাবে করতে পারো না, আমি একবারে জানতাম যে তুমি এটা ঠিকভাবে করতে পারবে না,” তবে এটা গ্যাসলাইটিংয়ের একটি প্রকাশ হতে পারে। একসময়, আপনি নিজেও ভাবতে শুরু করবেন, “কী সত্যিই আমি ঠিক কাজ করছি?”
২. সীমাহীন দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দেয়া
কর্মস্থলে গ্যাসলাইটিংয়ের একটি অন্যতম কৌশল হল অপরকে ক্রমাগত দায়ী করা এবং তার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া। বস বা সহকর্মীরা জানে যে এটি শিকারকে ক্রমাগত অপরাধবোধে ভরিয়ে দেয়, এবং শিকার তাদের কাজের মান নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে।
উদাহরণ: যদি আপনার বস বা সহকর্মী আপনার ওপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয় এবং বলবে, “তুমি তো এটা ভালোভাবে করতে পারো না, তুমি কিছুই ঠিকমতো করতে পারবে না,” তবে এটি মানসিকভাবে আপনার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করতে পারে।
৩. সহকর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা
কর্মস্থলে গ্যাসলাইটিং প্রক্রিয়ায় সহকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। বস বা গ্যাসলাইটার শিকারকে তার সহকর্মীদের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং বলে, “সে তো কিছুই জানে না, ওর সাথে কাজ করা সম্ভব নয়।” এতে শিকার তার সহকর্মীদের কাছে অপমানিত হয়ে পড়ে এবং তার সম্মান ও আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গ্যাসলাইটিংয়ের সাথে "Power Dynamics" বা ক্ষমতার সম্পর্ক গভীরভাবে যুক্ত। কর্মস্থলে বা পরিবারের মধ্যে, যেখানে একজনের উপর অন্যজনের নির্ভরশীলতা থাকে, সেখানেই গ্যাসলাইটিং সবচেয়ে বেশি কাজ করে। গ্যাসলাইটাররা ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে শিকারকে তার নিজস্ব বাস্তবতা এবং অনুভূতি সম্পর্কে সন্দেহ করতে বাধ্য করে। এটি তাদেরকে এমন এক জায়গায় নিয়ে আসে, যেখানে তারা গ্যাসলাইটারের কথার প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেতে থাকে।
নিজের অনুভূতিকে বিশ্বাস করুন: আপনার অনুভূতি সঠিক। কোনো ব্যক্তি বা পরিস্থিতি আপনাকে আপনার অনুভূতি সম্পর্কে সন্দেহ করতে বাধ্য করলেও, আপনি আপনার অনুভূতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন।
দৃঢ়ভাবে কথা বলুন: যখন কেউ আপনার অনুভূতি অস্বীকার করে, তখন সাহসীভাবে নিজের অবস্থান এবং অনুভূতি প্রকাশ করুন।
পেশাদার সহায়তা নিন: যদি গ্যাসলাইটিংয়ের প্রভাব গুরুতর হয়ে যায়, তবে একজন মনোবিদের সাহায্য নিতে ভুলবেন না।
সম্পর্কের মধ্যে সীমা তৈরি করুন: পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কের মধ্যে সীমানা তৈরি করুন, যাতে তাদের অপমানজনক আচরণ থেকে আপনি সুরক্ষিত থাকেন।
শেষ কথা:
গ্যাসলাইটিং শুধুমাত্র সম্পর্কের মধ্যে নয়, বরং পরিবার এবং কর্মস্থলেও একটি নীরব মানসিক নির্যাতনের রূপ নেয়। এটি শিকারকে ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা হারাতে বাধ্য করে। তবে, আপনি যদি নিজের অনুভূতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন, তবে আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে প্রতিরোধ করতে পারবেন।